ওবাইদুল হক চৌধুরী, উখিয়া নিউজ ডটকম
প্রকাশিত: ১২/০৬/২০২৪ ১০:১৮ পিএম , আপডেট: ১২/০৬/২০২৪ ১০:৩৩ পিএম

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অপর্যাপ্ত হেপাটাইটিস সি চিকিৎসা ব্যবস্থা এর কারনে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ শরণার্থীকে এ রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে নিরাময় করা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন::  উখিয়ায় এনজিও এমএসএফের নারী কর্মীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার!

মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের প্রায় ২০ শতাংশ শরণার্থীর মধ্যে সক্রিয় হেপাটাইটিস সি সংক্রমণ রয়েছে। রক্তবাহিত ভাইরাস, হেপাটাইটিস সি এমন একটি রোগ যা সংক্রামিত ব্যক্তিদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের জন্য কোন লক্ষন প্রকাশ ছাড়া নীরব থাকতে পারে। যদি চিকিৎসা না করা হয়, এটি লিভারকে আক্রমণ করতে পারে এবং গুরুতর বা এমনকি মারাত্মক জটিলতা স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, যেমন সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হতাশা এবং ক্লান্তি।

আরও পড়ুন::  আউটচার্জ সুপারভাইজার নিয়োগের দিচ্ছে এমএসএফ , কর্ম এলাকা জামতলি রোহিঙ্গা ক্যাম্প

ক্যাম্পে, মানুষের জন্য খুব সীমিত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। এমএসএফ ইতোমধ্যেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং বেঁচে থাকার জন্য মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল এই রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর জন্য এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি যৌথ মানবিক প্রচেষ্টা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হেপাটাইটিস সিতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য আসার হার দেখে, উপকেন্দ্র, এমএসএফ এর এপিডেমিওলজি এবং রিসার্চ সেন্টার, মে এবং জুন ২০২৩ এর মধ্যে সাতটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৬৮০ টি পরিবারের মধ্যে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে।

সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রায় এক তৃতিয়াংশ তাদের জীবনের কোন না কোন সময়ে হেপাটাইটিস সংক্রমণের সংস্পর্শে এসেছিল। এর মধ্যে, প্রায় ২০ শতাংশের মধ্যে সক্রিয় হেপাটাইটিস সি সংক্রমণ রয়েছে।

‘বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত জাতিগত সংখ্যালঘু হিসেবে, কয়েক দশক ধরে নিজ দেশে স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতির অভাবের মূল্য দিতে হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। ‌‌যে স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জামগুলি জীবাণুমুক্ত করা হয়নি, যেমন সিরিঞ্জ, যা শরণার্থী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিকল্প স্বাস্থ্যসেবা অনুশীলনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, তা সম্ভাব্য চলমান সংক্রমণ এবং অতিরিক্ত জনবহুল শিবিরে বসবাসকারী জনসংখ্যার মধ্যে হেপাটাইটিস সি-এর উচ্চ প্রাদুর্ভাবের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে’ বলে জানান বাংলাদেশে কর্মরত এমএসএফ এর মিশন প্রধান সোফি বেলাক।

সীমিত পরিসরে চালানো এই গবেষণার ফলাফলের সাথে পুরো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের তুলনা করলে বোঝা যায় যে প্রায় পাঁচ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন বর্তমানে এইচসিভি সংক্রমণের সাথে বসবাস করছে-সংখ্যাটি আনুমানিক ৮৬,৫০০ জন-এবং এ রোগ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন।

” এমএসএফ এর বেশির ভাগ মেডিকেল টিমকে প্রতিদিন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র থেকে হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হয়, কারণ বিপুল সংখ্যক রোগীর যত্ন বা চিকিৎসা নিশ্চিতের প্রয়োজনটা যত বিশাল তা চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী সংস্থার সামর্থ্যের চেয়েও অনেক বেশি। এই রোগীদের জন্য কোন বিকল্প পদ্ধতি এবং সাশ্রয়ী মূল্যের চিকিৎসা ব্যবস্থাও নেই ; : ক্যাম্পে এমএসএফ এর ক্লিনিকের বাইরে হেপাটাইটিস সি-র চিকিৎসা খুব কমই করা হয়। এটি সবচেয়ে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত একটি রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর জন্য একটি চূড়ান্ত পরিণতি, যারা ইতিমধ্যে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পরিণতির মুখোমুখি হচ্ছে “।

সোফি বেলাক আরও বলেন, অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ অপর্যাপ্ত, যা এই রোগকে জনস্বাস্থ্যের জন্য সম্ভাব্য হুমকির কারণ করে তুলেছে। তবুও, সরাসরি কার্যকর অ্যান্টিভাইরাল ওষুধগুলি ৯৫ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তিকে এ রোগ নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে। কক্সবাজারে জনবহুল শরণার্থী শিবিরে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস (এইচসিভি) নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। এমএসএফ একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি গত চার বছর ধরে সেখানে হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসা নিশ্চিত করছে। তবুও আরো চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রয়োজনটা সেখানে বিশেষভাবে বেশি। শরণার্থীদের আইনত কাজ করার বা শিবির ছেড়ে বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। যারা আমাদের সেবার আওতাধীন হতে পারে না, তাদের জন্য ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে ব্যয়বহুল রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়া এবং ওষুধের জন্য অর্থ প্রদান করা নাগালের বাইরে।

সোফি বেলাক আরও বলেন, “বেশিরভাগ শরণার্থীকে নিরাময় করা যায় না এবং তাদের জন্য বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিও অবলম্বন করা যায় না, যা কার্যকর নয় এবং তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির কারণও হতে পারে।” তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এবং সেভ দ্য চিলড্রেনের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাই যে, ক্যাম্পের দুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৯০০ জন হেপাটাইটিস সি রোগীর চিকিৎসা করা হবে। এটি সত্যিই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যা সঠিক পথে পরিচালিত। তবে, ভাইরাসের সংক্রমণ কার্যকরভাবে সীমিত করতে এবং লিভারের গুরুতর জটিলতা ও মৃত্যু এড়াতে একটি বড় আকারের প্রতিরোধ, ‘পরীক্ষা ও চিকিৎসা’ ক্যাম্পেইন প্রয়োজন। এর জন্য কক্সবাজারের ক্যাম্পে মানবিক প্রতিক্রিয়ার সমন্বয়কারীদের সম্পৃক্ততা ও দৃঢ় সংকল্পের প্রয়োজন হবে। শিবিরে বসবাসকারী শরণার্থীদের প্রতিটি প্রজন্ম হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত হয়। হেপাটাইটিস সি সংক্রমণজনিত যকৃতের জটিলতায় একজন আক্রান্ত ব্যক্তি মারাও যেতে পারে। সংক্রমণজনিত মারাত্মক জটিলতাগুলোর চিকিৎসা শরণার্থী শিবিরের ভেতরে সম্ভব না, যদিও (প্রাথমিক পর্যায়ে) রোগটির নিরাপদ,সহনীয়, কার্যকরী ও রোগী বান্ধব (তিনমাসের জন্য প্রতিদিন একটি করে ট্যাবলেট) চিকিৎসা আছে যা তুলনামুলকভাবে অনেক স্বস্তা।

ডব্লিউ. এইচ. ও-এর নির্দেশাবলী এবং এ প্রসঙ্গে এমএসএফ দ্বারা ব্যবহৃত সেবা ব্যবস্থার সরলীকৃত মডেলগুলি এই ধরনের মানবিক এবং স্বল্প-সম্পদ সেটিংসে খুব ভাল ফলাফল সহ এইচসিভি চিকিৎসা ব্যবস্থার কার্যক্রম বাড়াতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। গত দুই বছর ধরে এমএসএফ হেপাটাইটিস সি-এর চিকিৎসার জন্য জাতীয় ক্লিনিকাল নির্দেশিকা প্রণয়নে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও সহায়তা করেছে। এমএসএফ দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ, আন্তঃসরকারি ও বেসরকারী সংস্থাগুলির সাথে বড় আকারের প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি ভাইরাস সংক্রমণ সীমিত করতে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীদের চিকিৎসার জন্য সমস্ত কক্সবাজার শিবিরে একটি গণ ‘পরীক্ষা এবং সেবাপ্রদান’ প্রচার চালানোর জন্য কাজ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।

পাঠকের মতামত